মন্থরা ও সীতা –এক কাল্পনিক সংলাপ

Entry Thumbnail
ছবি : releated
Bikash Deb

‘মিস্টার সার্কুলার ঢুকছেন। এই, কেউ ওঁকে আমার কাছে পাঠাবে না ।‘ প্রিয়া কাগজপত্র ছড়িয়ে বসল । ‘আমার কাছেও না, আমি রেকর্ড–রুম থেকে ঘুরে আসছি ।‘ সঞ্জয় উঠে পড়ল । ‘আমার কাছে আসবেন না, গতবার আমার নামেই তো কমপ্লেন করেছিলেন। বেঁচে গেছি।‘ চৌধুরীদা গলা নামিয়ে বললেন । মৃন্ময় কানে ফোন নিয়ে কাল্পনিক কারও সঙ্গে কথায় ব্যস্ত রইল। বাকিরাও ব্যস্ততার আড়ালে লুকোনো শ্রেয় মনে করছে। এই ভরা কাজের সময় এমন একজন কাস্টমারকে ডিল করা সত্যিই সমস্যা। অফিসসুদ্ধ সবাইকে তটস্থ করে তুলতে ভালোবাসেন ইনি। আর প্রতিবারই একটা কমপ্লেন লিখে দিয়েও যাবেন। এখানে লিখিত দেবেন, তার কপি ইমেইল করে নানা জায়গায় দেবেন। কোনও কাস্টমার–সার্ভিসই ওঁর যথেষ্ট মনে হয় না, খুশি বা সন্তুষ্ট হওয়ার তো প্রশ্নই নেই। সবাই কাজ বা অকাজের অজুহাত দিলেও অনিন্দিতার এড়িয়ে থাকার উপায় নেই। হাসিমুখেই সামনের বসার জায়গার দিকে ইশারা করল, ’বলুন।‘ ‘আপনাদের অফিসে সবসময় এত ভিড় থাকে কেন? সবাই ব্যস্ত… একটা কাজের কথা শোনার সময় নেই কারও।‘ ‘ওই যে আপনি বললেন… ভিড়। সবাই তো কিছু না কিছু কাজ নিয়ে এসেছেন। আপনি বলুন, কী কাজ?’ ‘তো? ভিড় হচ্ছে যখন, স্টাফ বাড়ান। আরও দুটো অন্তত কাউন্টার বাড়ান।‘ ভদ্রলোকের গলায় ঝাঁঝ, ‘আমাদের সময়ের তো দাম আছে। কাজের কথা বলার জন্য দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করব নাকি?’ আপনি এসেছেন দু’মিনিটও হয়নি, কথাটা অবশ্য বলল না অনিন্দিতা, ’বলুন।‘ ‘বলছি। বলার জন্যেই তো এসেছি। তার আগে আমার কথাটার জবাব দিন। কাউন্টার বাড়াচ্ছেন না কেন?’ পেছনে লম্বা লাইন কাস্টমারদের, একটা দুটো গলা ভেসে এল, ’সেই তো। দুটো কাউন্টার, আর এত ভিড়। হয় নাকি?’ ভদ্রলোক এই অপেক্ষাতেই ছিলেন। গলার আওয়াজ বেড়ে গেল, ‘বলুন তো, আপনারা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেনই বা কেন? এইভাবে হ্যারাস করার কোনও অধিকার আছে এঁদের?’এই ওঁর অভ্যাস। কিংবা স্বভাব। হল্লা করে, চিত্‍কার করে, ছন্দপতন ঘটিয়ে সবাইকে তটস্থ করা। একটু শক্ত গলায় বলল অনিন্দিতা এবার, ’স্টাফ বাড়ানো বা কাউন্টার বাড়ানো আমাদের হাতে নেই।‘ ‘কেন নেই? আরবিআই সার্কুলার বলছে…’ নাতিদীর্ঘ ভাষণ এবার জনতাকে লক্ষ করে, ‘আমি দীর্ঘকাল অডিট বিভাগে কাজ করেছি, অমুক অফিসে। ডিজিএম হয়ে রিটায়ার করেছি। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের উচ্চপদস্থ একজন, তাকে যা-খুশি তাই বোঝাতে পারবে না।‘ চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিয়েছেন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ভিড়ের দিকে। অনিন্দিতা প্রতিক্রিয়াহীন অপেক্ষায়। এই আপাত উদাসীন নিস্ক্রিয়তা ভিড়ের প্রতিক্রিয়ায় রাশ টানে। দীর্ঘ কাজের জগতের অভিজ্ঞতা শিখিয়েছে। সামনের কম্পিউটার স্ক্রিনে মনোযোগী দৃষ্টি দিয়ে রাখল সে। তিন থেকে চার মিনিট। জ্ঞান বিতরণ অসমাপ্ত রেখেই ভদ্রলোক ঘুরে বসেছেন, ‘আচ্ছা, এই যে লকার নিয়ে এগ্রিমেন্ট করার নোটিস পাঠিয়েছেন আপনারা, স্ট্যাম্প–পেপার আনতে বলেছেন… কীসের ভিত্তিতে?’ ‘এটা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ইন্সট্রাকশন স্যার।‘ প্রতিটি বাক্য বলার সময় ‘স্যার’ উচ্চারণ এইরকম মানুষদের জন্য জরুরি। ‘আমাকে দেখান। আমি সেই ইন্সট্রাকশন সার্কুলার দেখতে চাই।‘‘আপনি তো সবই জানেন স্যার। অমুক অফিসের অত বড় পদ নিয়ে রিটায়ার করেছেন বললেন… এইভাবে সার্কুলার দেখানো…’‘দাঁড়ান,দাঁড়ান’, হাত তুলে থামিয়ে দিলেন ভদ্রলোক, ’রিটায়ার করে আমি আরবিআই-এর তমুক বিভাগে চিফ–কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করছি এখনও। আই অ্যাম নট আ রিটায়ার্ড পারসন।‘‘ওকে স্যার। তাহলে তো আপনি ভালোই জানেন যে আমার অফিসের ইন্সট্রাকশন আপনাকে দেখাতে পারি না আমি।‘ স্থির উচ্চারণ করল অনিন্দিতাও, ‘এখন তো আর-টি-আই করলেই সব জানা যায়।‘ ‘সে আমি জানি। আমি করব যা করার। আমি আপনাদের এম-ডি আর চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়েছি। এইভাবে হঠাত্‍ করে আবার এগ্রিমেন্ট চাইতে পারেন না আপনারা।‘ ‘ভালোই তো স্যার। এমডি কিংবা চেয়ারম্যান স্যার নিশ্চয়ই আপনার চিঠির উত্তরে সব জানিয়ে দেবেন।’ ‘আমি আপনার জানার জন্য বলছি। এই চেয়ারে বসেছেন, আপনার জানা উচিত যে এই স্ট্যাম্প-পেপার আপনারা চাইতে পারেন না। আরবিআই বলছে, স্ট্যাম্প-পেপারের টাকা আপনারা দেবেন। আমরা লকার রেন্ট দিয়ে অলরেডি আপনাদের টাকা দিচ্ছি। দ্বিতীয়ত, এইভাবে এগ্রিমেন্টের তিনদিকে সই করানোর নিয়ম নেই। আরবিআই সেটা বলছে না। আর সমস্ত লকার-হোল্ডারকে এসে সই করতে হবে, এটাও কোথাও লেখা নেই।‘ ‘এসে সই করতে হবে না স্যার। আপনি ফর্ম নিয়ে যান, সই করে কেউ একজন এসে জমা দিলেই হবে। বা কারও হাত দিয়ে পাঠালেও চলবে।‘ নাহ, ভদ্রলোক এত তাড়াতাড়ি উঠবেন না আজ। এমনিও বাইরে প্রবল বৃষ্টি পড়ছে। মৃন্ময় ইতিমধ্যেই মেসেজ করেছে একটা, ’বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত বসে থাকবেন ইনি। আপনি বরং কাজ দেখিয়ে আমার টেবিলে চলে আসুন।’খাতায়একটা সই নিতে আসার অছিলায় গুপ্তদাও বলে গেলেন, ‘উঠে ফোন হাতে নিয়ে দরজার দিকে যাও। আমি দোতলায় গিয়ে কল করছি।’ বললেই ওঠা যায়? একের পর এক কাজ নিয়ে কেউ না কেউ আসছেন, কাস্টমার কিংবা অফিস স্টাফ, কম্পিউটারে অ্যাপ্রুভাল কিংবা খাতা বা ভাউচারে সই— ভদ্রলোকের কথার মধ্যেই হাতের কাজ চলছে। উঠে গেলেও তো এসে বসতেই হবে। বিরক্ত লাগছে। কতক্ষণ আর এইসব কথামালা হজম করা যায়? ‘কাস্টমার ইজ কিং’ বলেই সব দায় ঝেড়ে ফেলেছে অফিস। রাজকীয় আদবকায়দা সামলাতে ফ্রন্ট-ডেস্কে বসে ক্রীতদাস-ভাব বজায় রাখতে হবে? ক্রীতদাসের অধিকার থাকতে নেই?

0 Comments

Leave a Comment